প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তনের ইতিহাস (২০০৫-বর্তমান)

প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তনের ইতিহাস (২০০৫-বর্তমান)


প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড পরিবর্তনের ইতিহাস, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রজ্ঞাপনের তারিখ এবং গ্রেড অনুযায়ী বেসিকের বিস্তারিত তথ্য জানুন। ২০০৫, ২০০৬, ২০১৪, ২০২০ ও ২০২৫ সালের আপগ্রেডেশন এবং বর্তমান গ্রেড ও বেতন স্কেল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেতে এই ব্লগটি পড়ুন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড যেভাবে পরিবর্তন হয়েছে


প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড এবং পদমর্যাদা নিয়ে গত দুই দশকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের গ্রেড উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় সঠিক প্রজ্ঞাপনের তারিখ এবং গ্রেড স্কেল নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। আজকের এই ব্লগে আমরা ২০০৫ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাস দালিলিক প্রমাণসহ আলোচনা করবো।

১. ২০০৫ ও ২০০৬ সাল: পরিবর্তনের সূচনা

২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড অনেক নিচে ছিল। পরবর্তীতে ২০০৬ সালের ২৯ আগস্ট একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষকদের গ্রেড প্রথমবারের মতো উল্লেখযোগ্য হারে আপগ্রেড করা হয়।

২০০৫ পর্যন্ত অবস্থা:

  • প্রধান শিক্ষক (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত): ১৫তম গ্রেড
  • প্রধান শিক্ষক (প্রশিক্ষণবিহীন): ১৭তম গ্রেড
  • সহকারী শিক্ষক (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত): ১৬তম গ্রেড
  • সহকারী শিক্ষক (প্রশিক্ষণবিহীন): ১৮তম গ্রেড

২০০৬ সালের আপগ্রেডেশন (প্রজ্ঞাপন তারিখ: ২৯/০৮/২০০৬): এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রেডগুলো নিম্নরূপ পরিবর্তন করা হয়:

  • প্রধান শিক্ষক (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত): ১৩তম গ্রেড
  • প্রধান শিক্ষক (প্রশিক্ষণবিহীন): ১৪তম গ্রেড
  • সহকারী শিক্ষক (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত): ১৫তম গ্রেড
  • সহকারী শিক্ষক (প্রশিক্ষণবিহীন): ১৬তম গ্রেড
২০০৬ সালে জারিকৃত প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তনের প্রজ্ঞাপন
২০০৬ সালে জারিকৃত প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তনের প্রজ্ঞাপন



২. ২০১৪ সাল: প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণির মর্যাদা

২০১৪ সালটি প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এই বছরের ৯ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা ৩য় শ্রেণি থেকে ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করার ঘোষণা দেন। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই ধাপে সহকারী শিক্ষকদের গ্রেডে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

২০১৪ সালের পরিবর্তন (প্রজ্ঞাপন তারিখ: ০৯/০৩/২০১৪):

  • প্রধান শিক্ষক (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত): ১১তম গ্রেড (বেসিক শুরু: ১২,৫০০ টাকা)
  • প্রধান শিক্ষক (প্রশিক্ষণবিহীন): ১২তম গ্রেড (বেসিক শুরু: ১১,৩০০ টাকা)

সহকারী শিক্ষকদের অবস্থা (তখনকার পে-স্কেল অনুযায়ী): সেসময় সহকারী শিক্ষকরা ২০০৬ সালের নিয়ম অনুসারেই বেতন পাচ্ছিলেন (জাতীয় পে-স্কেল ২০১৫ বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত)। পে-স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী তাদের অবস্থান ছিল:

  • সহকারী শিক্ষক (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত): ১৪তম গ্রেড
  • সহকারী শিক্ষক (প্রশিক্ষণবিহীন): ১৫তম গ্রেড


৩. ২০২০ সাল: সহকারী শিক্ষকদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ১৩তম গ্রেড

সহকারী শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি এবং প্রধান শিক্ষকদের সাথে বেতনের ব্যবধান কমানোর লক্ষ্যে ২০২০ সালে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন—উভয় ধরনের সহকারী শিক্ষকদের একই গ্রেডে নিয়ে আসা হয়।

২০২০ সালের পরিবর্তন (প্রজ্ঞাপন তারিখ: ০৯/০২/২০২০):

  • সহকারী শিক্ষক (সকল): ১৩তম গ্রেড
  • বেসিক (শুরুর ধাপ): ১১,০০০ টাকা (জাতীয় পে-স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী)।

এই প্রজ্ঞাপনের ফলে সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে প্রশিক্ষণ থাকা বা না থাকা নিয়ে যে বেতন বৈষম্য ছিল, তা দূর হয়।

২০২০ সালে সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড প্রদানের সরকারি আদেশ
২০২০ সালে সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড প্রদানের সরকারি আদেশ

৪. ২০২৪-পরবর্তী: প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড ও গেজেটেড মর্যাদা

দীর্ঘ আইনি লড়াই এবং আন্দোলনের পর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণির মর্যাদা ঘোষণা করলেও তা ১১তম গ্রেডে আটকে ছিল। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায়ে প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

সর্বশেষ অবস্থা ও ১০ম গ্রেড বাস্তবায়ন: উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী, প্রধান শিক্ষকরা ০৯ মার্চ ২০১৪ তারিখ থেকেই ১০ম গ্রেড এবং ২য় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মর্যাদা ও সুবিধাদি প্রাপ্য হবেন। সরকারের সাম্প্রতিক নির্দেশনায় এই গ্রেড বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

  • পদমর্যাদা: ১০ম গ্রেড (২য় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা)
  • বেতন স্কেল (২০১৫ অনুযায়ী): ১৬,০০০ - ৩৮,৬৪০ টাকা।
  • মূল বেতন (Basic): শুরুর ধাপ ১৬,০০০ টাকা।

এর ফলে প্রধান শিক্ষকরা এখন ১১তম গ্রেডের (বেসিক ১২,৫০০) পরিবর্তে ১০ম গ্রেডের (বেসিক ১৬,০০০) সুবিধা পাবেন, যা প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে এবং শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে একটি ঐতিহাসিক অর্জন।

প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড বাস্তবায়নের নির্দেশনার কপি
প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড বাস্তবায়নের নির্দেশনার কপি



একনজরে পরিবর্তনের চিত্র (সারসংক্ষেপ)

পাঠকদের সুবিধার্থে পুরো ইতিহাসটি একটি ছকের মাধ্যমে তুলে ধরা হলো:

সময়কালপ্রধান শিক্ষক (গ্রেড)সহকারী শিক্ষক (গ্রেড)মন্তব্য
২০০৬ (২৯ আগস্ট)১৩তম ও ১৪তম১৫তম ও ১৬তম২০০৫ পে-স্কেল অনুযায়ী।
২০১৪ (০৯ মার্চ)১১তম ও ১২তম১৪তম ও ১৫তমপ্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণির ঘোষণা।
২০২০ (০৯ ফেব্রুয়ারি)১১তম ও ১২তম১৩তম (সকল)সহকারী শিক্ষকদের গ্রেড উন্নয়ন।
বর্তমান (২০২৪-২৫)১০ম গ্রেড (বাস্তবায়নাধীন)১৩তম (আন্দোলনরত ১১তম)আদালতের রায়ে প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড প্রাপ্তি।
একনজরে প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তননের সকল পরিপত্র
একনজরে প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তননের সকল পরিপত্র

বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন, তবে তারা ১০ম বা ১১তম গ্রেডের দাবিতে আন্দোলনরত। অন্যদিকে, প্রধান শিক্ষকদের দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ১০ম গ্রেড বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

শিক্ষকদের এই গ্রেড পরিবর্তন শুধুমাত্র বেতনের অংক নয়, বরং এটি তাদের সামাজিক মর্যাদা এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের সাথে সরাসরি জড়িত। আশা করি, এই তথ্যগুলো আপনার বিভ্রান্তি দূর করতে সহায়তা করবে।


আপনার যদি কোনো নির্দিষ্ট প্রজ্ঞাপন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার থাকে, তবে নিচে কমেন্ট করতে পারেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন